আর্টিকেলটিতে যে সব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে...
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হল অস্থি সন্ধির (Joints) প্রদাহ (Inflammation) জনিত রোগ। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, ঘটমান (Progressive), অটো ইমিইউন রোগ/ডিজিজ। প্রথম দিকে হাত ও পায়ের পাতা আক্রান্ত হলেও ধীরে ধীরে অন্যান্য জয়েন্টে তা ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে সাধারণত শরীরের উভয় দিকের একি জয়েন্ট গুলো আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই রোগের কারণে কিছু কিছু সময় রোগীর চোখ, ত্বক, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, এবং রক্ত নালীও আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। যখন আপনার ইমিইউন সিস্টেম ভুল করে আপনারই শরীরের টিস্যু গুলোকে আক্রমণ করতে শুরু করে তখনই এই রোগ হয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস অস্টিও আর্থ্রাইটিস রোগের মতো কারটিলেজ ক্ষয় বা ছিঁড়ে যাবার কারণে হয় না বরং তা হয় অস্থিসন্ধির চারপাশ আক্রান্ত হবার মাধ্যমে । ফলে ব্যাথার সাথে সাথে জয়েন্টের চারপাশ বেশ ফুলে যেতে পারে। সাথে জয়েন্টের ক্ষয় সাধন এবং বিকলাঙ্গতাও হতে পারে।
একদম শুরুর দিকে ধরা পরলে বা আপনার যে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হয়েছে সেটা আন্দাজ করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ অনেকটাই নিরাময় সম্ভব। তাই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর লক্ষণ গুলো জানা অতি জরুরী।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কিভাবে হয়
এই রোগ হয় কিভাবে এবং এর ফলে কি হয় তা একজন সাধারণ মানুষের জন্য জানা জরুরি না হলেও একজন মেডিকেল স্টুডেন্টের জন্য জানা অতি জরুরি এবং তারা জানেও। তারপরও এই বিষয়ে সামান্য আলোচনা করব এখন।
এটি তখনই হয় যখন রোগীর ইমিইউন সিস্টেম তার নিজ শরীরের জয়েন্ট গুলোর সাইনোভিয়াল মেমব্রেনকে আক্রমণ করে। ফলে ইনফ্লাটেডেট সাইনোভিয়াল মেম্ব্রেন পুরু হয়ে যায়, এবং একটা সময় হাড়ের জয়েন্ট ও কার্টিলেজ ধ্বংস হয়ে যায়।
এছাড়া হাড়ের জয়েন্ট গুলোকে ধরে রাখতে যে টেন্ডন এবং লিগামেন্ট গুলো নিয়োজিত সেগুলোও দুর্বল এবং স্ট্রেচ হতে থাকে। যার ফলে হাড় তার স্বাভাবিক গঠন এবং আকার হারাতে থাকে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কেন হয়
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগটি কিভাবে হয়, এর ফলে কি হয় তা আমরা জানলাম। কিন্তু তা কেন হয় সেটা জানা আবশ্যক নয় কি? আসুন দেখে নেয়া যাক রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হবার প্রধান প্রধান কারণ গুলা।
জিনের পরিবর্তনের কারণে হতে পারে।
অতীতে বংশে (Genetic) কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে।
ভাইরাল ইনফেকশনের কারণে হতে পারে।
হরমোনের পরিবর্তন জনিত কারণে হতে পারে।
ধূমপানের কারণে হতে পারে।
অতিরিক্ত ওজনের (Obesity) কারনেও হতে পারে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগের লক্ষণ (Sign and symptom)
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি আক্রান্ত হয় এবং বয়স ভেদে ২৫-৫০ বছর বয়সী মানুষদেরই এই রোগ হয়। এই রোগে শিশু আক্রান্তের হারও লক্ষণীয়।
প্রতিদিন সকাল বেলা তীব্র ব্যাথা অনুভব করা এবং দিন গড়ানোর সাথে সাথে তা কমতে থাকা।
সকালের দিকে জয়েন্ট গুলো শক্ত (Joint Stiffness) অনুভব করা।
আক্রান্ত জয়েন্ট গুলা ফুলে (Swealling) যাওয়া।
শরীরের উভয় দিকের একি জয়েন্ট গুলোতে তীব্র ব্যাথা অনুভব করা।
ব্যাথার পাশাপাশি শরীরে জ্বর জ্বর ভাব হওয়া।
বুকে ব্যাথা।
ওজন কমে যাওয়া।
মুখ চোখ শুকনো হয়ে যাওয়া।
অ্যানেমিয়া (Anemia) বা রক্ত স্বল্পতা হওয়া।
রিউমাটিক নডিউল দেখা যাওয়া।
ক্লান্তি ভাব আসা।
মনে রাখতে হবে লক্ষণই রোগ শনাক্তের জন্য শতভাগ যথেষ্ট নয়। এর জন্যে প্রয়োজন টেস্ট এবং সঠিক নিরীক্ষণ। অবশ্যই একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন রোগ ধরতে এবং সঠিক চিকিৎসা পেতে। লক্ষণ আমাদের সজাগ করাতে পারে। দ্রুত চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
কিভাবে ডায়াগনোসিস হয়
প্রাথমিক ভাবে এটি ডায়াগনোসিস করতে রোগীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। দেখা হয় রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস এর লক্ষণ গুলা রোগীর আছে কিনা। এবং পরবর্তীতে কিছু ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা হয়। এর বাহিরে একজন চিকিৎসক রোগীর যেসব জিনিস দেখেন সেগুলো হল,
জয়েন্ট ফুলে গেছে কিনা।
জয়েন্টে লালচে ভাব আছে কিনা।
জয়েন্টের রেঞ্জ অব মোশন (Range of motion) ঠিক আছে কিনা।
জয়েন্টে গরম (Warmth) ভাব পাওয়া যায় কিনা।
জয়েন্টের ভঙ্গুরতা (Tenderness) কেমন।
জয়েন্টের রিফ্লেক্স (Joint reflex) এবং মাংস পেশীর শক্তি (Muscle strength) পরীক্ষা করে দেখা হয়।
এগুলোর মাধ্যমে যদি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হয়েছে বলে মনে হয় তখন একজন চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষা দিতে পারে। রক্ত পরিক্ষায় অ্যাকিউট ফেইজ রিএক্টেন্টস (Acute phase reactants) লেভেল দেখা হয়। শরীরে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ হলে এর লেভেল বেড়ে যায়। এছাড়াও আরও অনেক রকমের রক্ত পরিক্ষা আছে যেগুলো প্রয়োজন হলে চিকিৎসক দিতে পারেন। তার মধ্যে সিবিসি উইথ সি আর পি আর এ টেস্ট, সেরাম ইউরিক এসিড টেস্ট, এ এন এ এন্টিবডি টেস্ট, এন্টি সিপিসি টেস্ট ইত্যাদি অন্যতম। জয়েন্টের এক্সরেও করা হয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগের চিকিৎসা
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগ কখনো ভালো হয় না, তবে প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ ধরা পরলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থতা লাভ করা যায়। যার জন্যে প্রয়োজন এই রোগ সম্পর্কে জানা এবং সচেতন থাকা।
মেডিকেশনের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস রোগের চিকিৎসা করা হয়। এই রোগে তিন ধরনের ঔষধ নিয়মিত ব্যবহার করা হয়।
অ্যানালজেসিক বা ব্যথানাশক/পেইন কিলার ঔষুধ
অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি বা প্রদাহবিরোধী ঔষুধ
ডিএমএ আরডি (DMARD) বা ডিজিজ-মডিফাইং অ্যান্টি রিউম্যাটিক ড্রাগস
এছাড়া স্টেরয়েড এবং জয়েন্টে ইনজেকশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
পেইন কিলার বা ব্যথা নাশক ঔষধ
অ্যাসপিরিন
আইবুপ্রফেন
কিটোপ্রফেন
ন্যাপ্রোক্সেন
পাইরোক্সিকাম ইত্যাদি
ডিএমএআরডি (DMARD) জাতীয় ঔষধ
গোল্ড (সোডিয়াম অরোথিওম্যালেট) – ইনজেকশন আকারে এবং মুখে। এটি বেশি দিন ব্যবহার না করাই উত্তম।
সালফাস্যালাজিন
পেনিসিলামাইন
ক্লোরোকুইন
ড্যাপসন ও লিভামিসল
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগে ফিজিওথেরাপী
ঠাণ্ডা এবং গরম সেঁক দেয়া (Cold/Hot therapy)
প্রাথমিক পর্যায়ের (Acute stage) রোগী হলে ব্যায়াম শুরু করার আগে রোগীকে বরফ থেরাপী (Cold therapy) দিতে হবে। আর যদি রোগী ক্রনিক পর্যায়ের (Chronic stage) হয় তবে রোগীকে গরম সেঁক (Hot therapy) দিতে হবে। রোগী কোন পর্যায়ে (Stage) আছে তা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন।
টেন্স মেশিন (TENS)
ব্যাথা কমানোর জন্য টেন্স (TENS) মেশিন ব্যবহার করা হয়।
হাইড্রোথেরাপী-বেলেনোথেরাপী (Hydrotherapy-Balenotherapy)
জয়েন্টে কিছু ওজন দিয়ে ব্যায়াম করানো হয়।
এর বাহিরে ম্যাসাজ থেরাপী, স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ, স্ট্রেন্দেনিং এক্সারসাইজ, ব্যালান্স অ্যান্ড কো অরডিন্যাশন এক্সারসাইজ করে থাকেন ফিজিওথেরাপী চিকিৎসকগণ।
বাসায় করনীয়
এছাড়া রোগী হিসেবে আপনি বাসায় কিছু জিনিস করতে পারেন যেগুলো আপনাকে অনেকটাই সুস্থ ও প্রানবন্ত রাখবে।
নিয়মিত হালকা ধরনের ব্যায়াম করবেন।
ব্যাথা এবং জ্বালাপোড়ার সময় গুলাতে বিশ্রাম নেয়া।
হিট/কোল্ড থেরাপী দেয়া।
স্প্লিন্ট অথবা ব্রেচ ব্যবহার করতে পারেন জয়েন্টকে রেস্টিং পজিশনে রাখতে।
এগুলো করার পাশাপাশি রোগীর খাদ্য তালিকার মধ্যে ব্লু বেরি, স্ট্রবেরি, ডার্ক চকোলেট, তিসি, আখরোট, ব্রকলি এবং গ্রীন টি রাখা যেতে পারে। এই খাবার গুলো রোগীর ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ কমিয়ে আনতে সহায়তা করে।